জ্যৈষ্ঠের ভরদুপুর। ঠাঠাপড়া রোদের তাপে মাঠি থেকে ভাপ ওঠছিল। ফেরিওয়ালার হাঁক-পাঁক এবং আইস্ক্রিমওয়ালার ঘণ্টার শব্দে ঝিঙের ফুল পর্যন্ত আইঢাই করছিল। অনিচ্ছাসত্ত্বেও গ্রৈষ্মিক গরমে তাপক্লান্ত এক যুবক হাঁটছিল। ঘামে জবজব শার্ট বলিষ্ঠ দেহে অষ্টে-পৃষ্ঠে এঁটেছিল। হঠাৎ থমকে বাতাসে ঘ্রাণ শুঁকে ডানে বাঁয়ে তাকায়। বাসার প্রবেশদ্বারে বিভাসালয় লেখা। কপালের ঘাম মুছে চারপাশে তাকিয়ে কিছু ঠাহর করার চেষ্টা করে। তার হাবভাবে উদ্গ্রীবতা এবং দিগ্ভ্রান্তির দুশ্চিন্তা চোখে মুখে স্পষ্ট। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নিম্নকণ্ঠে যুবক বললো, “গরমের কালে আহাল শুরু হয়েছে। বিষাদিত বাতাসে মন বিষাক্ত হয়েছে। আমি অবাকদৃষ্টে তাকিয়ে থাকি। অনেকে বলে আমার বুদ্ধিতে ঘুণ ধরেছে। অত্যন্ত দুর্দান্তের দুর্দশা দেখে বিদ্বান ব্যক্তি চিন্তিত হয়েছে এবং বরফট্টাই ঠাটবাটে তল্লাটের বড়লাট হওয়ার হিড়িক পড়েছে।”
এমন সময় বাসার সামনে গাড়ি থামে এবং তার দিকে তাকিয়ে চালক বললেন, “গেট খুলে দিলে তোমার জন্য দোয়া করব।”
গেট খুলে দিলে কিছু না বলে উনি দ্রুত চালিয়ে ভিতরে যান। গেট লাগিয়ে হাঁটতে শুরু করে যুবক বললো, “উনি বলেছিলেন গেট খুলে দিলে আমার জন্য দোয়া করবেন। আমি গেট খুলে দিয়েছিলাম এবং উনি ভিতরে চলে গিয়েছিলেন।”
উনি দৌড়ে গেটের পাশে যেয়ে ডানে বাঁয়ে তাকিয়ে তাকে ডেকে বললেন, “যুবক, ফিরে আসো।”
“এখন আবার কী কাজ করাতে চান?” বলে যুবক ঘুরে কপাল কুঁচকে বললো, “আমাকে ডেকেছেন নাকি?”
“হ্যাঁ, ফিরে আসো।”
যুবক দ্রুত গেলে তার মুখের দিকেয়ে তাকিয়ে উনি বললেন, “কিছু খেয়েছ?”
“জি না।”
“আমিও খাইনি। ভিতরে আসো, আমার সাথে খাবে।”
“অনেক ধন্যবাদ। কাজ করাতে চান নাকি?”
“ভিতরে আসো, খাবার টেবিলে বসে কাজরে কথা বলব।” বলে উনি হাঁটতে শুরু করেন। যুবক মাথা নেড়ে অনুসরণ করলে হাতের ইশারায় পাশে ডেকে উনি বললেন, “আমার পাশে আসো।”
পাশে গেলে উনি বললেন, “তোমার নাম কী?”
“আমার আম্মা আমাকে মঞ্জু ডাকতেন।”
“আমিও ডাকব।”
“আপনার ইচ্ছা। চাইলে ডাকতে পারবেন।”
“কোথায় থাকো?”
“গলাধাক্কা দিয়ে আমার বাবা আমাকে বাড়ি থেকে বার করেছেন। উদ্বাস্তু হয়ে আমি ভবঘুরের মত আপন গরজে ঘুরে বেড়াচ্ছি।” বলে মঞ্জু মুখ বেজার করে। তার আপাদমস্তক নিরীক্ষা করে গম্ভীরকণ্ঠে উনি বললেন, “কেন?”
“আমি নাকি কুলাঙ্গার।”
“কুলাঙ্গার শব্দের অর্থ কী?”
“বংশের নাম ডুবানো ছেলে। বাপ মায়ের লজ্জা। বাপে খেদানো মায়ে তাড়ানো।” বলে মঞ্জু উনার মুখের দিকে তাকিয়ে তর্জনী দেখিয়ে বললো, “আমার একটা অভিযোগ আছে।”
“কী?”
“গর্ভধারিণী আমার আম্মা এখন বেহেস্তে। তদ্দরুন সৎমায়ের লজ্জা এবং সৎমায়ের তাড়ানো বলে অভিযোগ তুলতে চাই।” বলে মঞ্জু উঁকিলের মত মাথা দুলায়। মৃদুহেসে উনি বললেন, “আমার আম্মা আমাকে বেশি আদর করতেন তাই আমি আমার মেয়েকে বেশি আদর করি।”
মঞ্জু দাঁত কটমট করে বললো, “আমার ছেলে হাঁটতে শুরু করলে তাকে আমি উচিত শিক্ষা দিতে শুরু করব যাহাতে লজ্জার কারণ না হয়। থাপড়িয়ে দাবড়িয়ে উচিত শিক্ষা দিলে আমার মত খালি পেটে পথে পথে হাঁটবে না।”
উনি শরীর কাঁপিয়ে হেসে বললেন, “এই জন্য বিভাসা খিল খিল করে হেসেছিল। যাক, লেখাপড়া না চাকুরি করতে চাও?”
“আমি জানি না।”
“কাজের কথা পরে বলব এখন ভিতরে চলো।” বলে উনি দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে বসারঘরে প্রবেশ করে পিছন ফিরে তাকিয়ে তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মৃদু হেসে বললেন, “ভিতরে আসছ না কেন?”
“আপনি আমাকে চিনেন না।”
“আমি তোমাকে চিনতেও চাই না। আমার মেয়ে তোমাকে চিনেছে। পরিচয় এবং পরিচিতি আমাদের জন্য নিষ্প্রয়োজন। দিন-রাত কাজ করে যারা সন্ন্যাসরোগে আক্রান্ত হয় তাদের একজন আমি।”
“আপনি যা বুঝাতে চেয়েছেন তা আমি বোঝিনি। দয়া করে বুঝিয়ে বলবেন কি?”
“আমার মেয়ে…।” বলে উনি সোফায় বসে মাথা নত করে ডুকরে কাঁদলে মঞ্জু দ্রুত উনার পাশে যেয়ে ব্যস্তকণ্ঠে বললো, “আপনার মেয়ের কী হয়েছে?”