“ভাবগম্ভীর ভালোবাসার গল্প”
অশ্বত্থতলে বসে এক বৃদ্ধ সুরের মোহে বিমোহিত হয়ে বেহালা বাজাচ্ছিলেন। ফুরফুরে বাতাসে বটের ঝুরি দুলছিল। একটা নামী দামী মটরগাড়ি রাজপথ দিয়ে আসছিল। অলস দুপুর, দু একটা পাখি ডাকছিল। ভার মনকে হাল্কা করার জন্য বুক ভরে শ্বাস টেনে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বৃদ্ধ শান্তকণ্ঠে বললেন, “জীবনে কত জনের বন্ধু হলাম। নিজে কুঁজো হয়ে অন্যকে কলাকুশলী করলাম আমি কষ্টে ক্লিষ্ট হলাম। বন্ধুরা পর হল, পর আপন হয় না জানলাম। তবে আমি তা কাউকে খুশি করার জন্য করিনি, নিজের শান্তির জন্য করেছিলাম। যা শুধু অন্তর্যামী জানেন।”
এমন সময় চকমিলানো প্রাসাদের সামনে গাড়ি থামলে দারোয়ান গেট খুলে দেয়। ফটক পেরিয়ে দর-দালানের সামনে গাড়ি থামিয়ে চালক দ্রুত বেরিয়ে পিছনের দরজা খুলে সরে দাঁড়ায়। ভদ্রলোক এবং ভদ্রমহিলা বেরিয়ে একে অন্যের দিকে গম্ভীর দৃষ্টে তাকান। সামনের সিটে এক সুদর্শন যুবক বসা। বেরোচ্ছে না দেখে ভদ্রলোক তার দিকে তাকান। আয়নায় উনার দৃষ্টিভঙ্গি দেখে যুবক গড়িমশি করে বেরিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। ভদ্রলোক গাড়ি থেকে বেরিয়ে হাঁটতে শুরু করে গম্ভীরকণ্ঠে ডেকে বললেন, “শামীম, আজ যাকে দেখেছি ওর সাথে তোর বিয়ে হবে।”
উনি আরো কিছু বলতে চাইলে শামীম ডানে বাঁয়ে তাকিয়ে মাথা নেড়ে সাধারণকণ্ঠে বলল, “আমি ওকে বিয়ে করব না।”
“কী বললে?” ভদ্রলোক গর্জে উঠলে ভদ্রমহিলা চমকে ডানে বাঁয়ে তাকান। চালক ভয়ে কাঁপতে শুরু করে। দারোয়ান অদৃশ্য বিপদের জন্য প্রস্তুত হয়। ভদ্রলোকের চোখের দিকে তাকিয়ে শামীম বলল, “ওকে আমি বিয়ে করব না। চরিত্রহীনদের সাথে আমি সম্পর্ক রাখি না।”
“আমার বাড়ি থেকে এখুনি বেরিয়ে যা। আমি তোকে ত্যাজ্য করলাম।” রাগান্বিতকণ্ঠে বলে ভদ্রলোক হাত দিয়ে ইশারা করেন। আর কথা না বলে শামীম মৃদু হেসে মা”র দিকে তাকায়। মা মুখ ফিরালে আর কারো দিকে না তাকিয়ে বুক ভরে শ্বাস টেনে ধীরে ধীরে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দ্রুত বেরিয়ে যায়। নিরুপায় এবং অসহায়। কেঁথা বালিশ কিছু নেই, বুকের ইমান তার একমাত্র সম্বল। মুণি ঋষিরা বলেন, সর্বান্তর্যামী আল্লাহ হলেন নির্বান্ধবের বান্ধব এবং ধর্মকর্মে ব্রতীরা সহজে ধর্ম-অর্থ-কামে মোক্ষলাভ করে। আল্লাহে বিশ্বাসী শামীম “বিছমিল্লাহি তাওয়াক্কালতু আলাল্লাহ” বলে অজানা গন্তব্যের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। তার হাবভাব দেখে আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হয়, গাছগাছালি ঝিম ধরে। পরিপার্শ্বে গম্ভীর্যতা, সন্ধ্যা হয় হয়। পাখিরা নীড়ে ফিরছিল। আস্তেব্যস্তে ঈশান কোণে মেঘ জমে এক ফোঁটা দুই ফোঁটা করে বৃষ্টি ঝরে, কখন আকাশ ভেঙে বৃষ্টি ঝরতে শুরু করবে তা কেউ জানে না। শামীম আস্তে ধীরে হাঁটে, তার মুখ বেজার। খোলাকাশের নিচে বৃষ্টিচ্ছায় দাঁড়িয়ে চিন্তার সাগরে ডুব সাঁতার কাঁটে। হঠাৎ আকাশ ভেঙে ঝেঁপে বৃষ্টি ঝরতে শুরু করলে দৌড়ে বাজারের পুকুর পাড়ের হাওয়াখানায় আশ্রয় নেয়। এক পশলা বৃষ্টি ঝরে আস্তেধীরে আকাশ পরিস্কার হয়, প্রকৃতি স্তব্ধ। পুকুর পাড়ের হিজল গাছের ডালে বসা পাখিদের ডাক এবং পাতায় জমা বৃষ্টিজল টাপুরটুপুর করে পুকুরে পড়ে মোহতিমির পরিবেশে ভাবাবেশ সৃষ্টি করে। বাদলসাঁঝে পুকুর জলে বৃষ্টিজল ঝরার শব্দ নীরবতার প্রতিধ্বনির মত হয়, যা শুধু বিরহীরা শুনতে পায় এবং সুরে ছন্দ মিলিয়ে তালে বৈতালে দুঃখের বারমাসী গায়। শামীম তাদের একজন। বৃষ্টির টাপুরটুপুর এবং বাতাসের শন-শন শব্দের সাথে সুর মিলিয়ে গুনগুনি করে। বৃষ্টি থামলে বুক কাঁপিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ধীরপায়ে হেঁটে রাস্তায় উঠে পথহারা পথিকের মত হাঁটতে শুরু করে। বাস থেমে যাত্রী নামাচ্ছে দেখে দৌড়ে দেবে এমন সময় নাম ধরে কেউ ডেকে বলল, “শামীম! কোথায় যাচ্ছিস?”
শামীম পিছু হেঁটে ঘুরে মৃদুহেসে বলল, “আরে শাকিল, তুই এখানে কী করছিস? আমি সিলেট যাব।”
“তোর কী হয়েছে, আজ এত বেজার কেন?”
“আমার আব্বা আমাকে ত্যাজ্য করেছেন, তাই আমি নিরুদ্দিষ্ট গন্তব্যের খুঁজে বেরিয়েছি। থাক আমার কথা, ত্রিসন্ধ্যায় আমাদের গ্রামে এসেছিস কেন?” বলে শামীম আড়চোখে তাকালে শাকিল গম্ভীরকণ্ঠে বলল, “তোর সাথে দেখা করার জন্য এসেছিলাম। চাচা তোকে ত্যাজ্য করবেন কেন, বক বক করে আমাকে বোকা বানাতে চাস নাকি?”
“আমি নিজে এখন বোকাকান্ত হয়েছি, তোকে বোকা বানালে খোকাবাবু আমাকে নাকানিচুবানি খাওয়াবে। যাক, ভাবীর খবর কী, খোকাবাবু এখন কত বড় হয়েছে? অনেকদিন হয় খোকাবাবুকে দেখিনি। অনেক বড় হয়েছে তাই না?” বলে শামীম মৃদু হাসলে শাকিল চিন্তিতকণ্ঠে বলল, “আজ এমন করে কথা বলছিস কেন?”
“আমি এখন পথের পাঁচালী। ঘর নেই গন্তব্য নেই, যেদিকে মন যেতে চাইবে সেদিকে যাব। তুই চলে যা।” বলে শামীম হাঁটতে শুরু করে।