অপ্সরা হলো অত্যন্ত সুন্দর অতিপ্রাকৃত নারী সত্তা এবং গল্পের নায়িকার নিকটাত্মীয়া। নাটকীয় হলেও অনেক ঘটনা বাস্তব ভিত্তক। নায়িকা হলো পাহাড়ি অঞ্চলের মোড়লের একমাত্র নাতিনি। হিংস্র জীবজন্তু এবং সহিংস মানুষ নিয়ন্ত্রণে অত্যন্ত পারদর্শী। আত্মরক্ষার হাতিয়ার স্বরূপ ভোজালি কোমরে রাখে। কালো তেজী ঘোড়ায় চড়ে রাতবিরেতে বন্য মোরগ শিকার করে। একরাতে পাহাড়চূড়ায় বসে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করছিল, হঠাৎ দৃষ্টির শেষ সীমায় রহস্যময় নারী আবির্ভূত হয় এবং সেই সময় চোরাশিকারির ফাঁদে আটকে বাঘ আর্তনাদ করে। কলেকৌশলে বাঘ উদ্ধার করে পায়ে জড়িবুটি বেঁধে প্রাথমিক চিকিৎসা করলে বাঘ ওর পোষ্য হয়। নায়ক গ্রীষ্মের ছুটিতে দেশে আসে এবং খাদিমনগর জাতীয় উদ্যানে কয়েকটি ভুতুড়ে কার্যকলাপ প্রত্যক্ষ করে এবং পরে দিগভ্রান্ত হয়ে গহীন বনে প্রবেশ করে নায়িকার সাথে পরিচিত হয়ে দুজন মিলে রহস্যময় নারীর রহস্য উদ্ঘাটন করার পর তাদের শুভ পরিণয় হয়।
মানসসুন্দরী শর্মী ব্যাধিনী বেশে বনগহনে ঘোরে বেড়াচ্ছিল। হঠাৎ অলীক পরিবেশে প্রবেশ করে কৌতূহলোদ্দীপক হয়। সূর্যাস্তের শুরুতে চাঁদের আলোয় পরিবেশ স্বপ্নীল হলে আকস্মিকভাবে বিদ্রূপাত্মক বাক্য পরিবেশে ভাসে… "শর্মী! মরি-মরি জপে লজ্জায় লাল হওয়ার জন্য জংলায় এসেছিস কেন?" শর্মী দাঁত কটমট করে বলল… "রে কুক্কুট! খালি হাতে আসলেও তোদের একটাকে মেরেকেটে শিকে পুড়ে খাওয়ার জন্য যথেষ্ট মশলাপাতি সঙে আছে। মনে রাখিস! তীক্ষ্ণ তির বুকে বিঁধলে হাঁকাহাঁকির পালা পলকে সাঙ্গ হবে।” শর্মী যখন ধুনতে তির সংযোগ করে অপ্সরা তখন মোহনসুরে গান গেয়ে হাঁটছিল… "হিরণবরন পাখি জিয়নে মরণে হয়েছে মোর সখি, সুখিনী হওয়ার জন্য হতে চাই সখার মুখোমুখি।" শর্মী অপলকদৃষ্টে অপ্সরার দিকে তাকিয়ে বিস্ময়াবিষ্ট কণ্ঠে বলল... "ক্যানক্যানে গলায় গান গেয়ে টিনটিনে লোক কানে বাড়ি খেয়েছে, নারীর নিগূঢ় রহস্যে পরিবেশ রহস্যময় হয়েছে।" হঠাৎ বাতাসে বাঘের হুংকার প্রতিধ্বনিত হলে অপ্সরা পরিবেশে অদৃশ্য হয়। শর্মী ধুন তাক করে চারপাশে তাকিয়ে কিছু দেখতে না পেয়ে হেঁকে ডেকে বলল... "টাট্টু! দৌড়ে আয়।” ডাকের সাথে সাথে ঘোড়ার খুরের আওয়াজ বাতাসে প্রতিধ্বনিত হয়। চিকচিকে কালো এবং তেজি আরবি-ঘোড়া সামনের ঠ্যাং তুলে হ্রেষাধ্বনি করে বশ্যত্বের প্রমাণ দিয়ে স্থির হয়ে মাথা নেড়ে কান শরীর ঝাড়ে। শর্মী ডান হাতে লাগাম ধরে বাম হাত ঘোড়ার গায়ে বুলিয়ে বলল… “বাঘের হুঙ্কার শুনেছি। সবাইকে সতর্ক করতে হবে।” ঘোড়া উত্তেজিত হয়ে আগপিছ করে। শর্মী দক্ষ আরোহীর মত লাগাম ধরে রেকাবে পা রেখে টপকি দিয়ে উঠে বসে সামনে তাকিয়ে কান পেতে কিছু শুনতে না পেয়ে ধনুতে তির সংযোগ করে গায়ের জোরে টানিয়ে ছেড়ে লাগাম ধরে উত্তেজিত কণ্ঠে বলল... "টাট্টু! দৌড়া।" ঘোড়া হ্রেষাধ্বনি করে মহাবেগে দৌড়ে। শর্মী বার বার ঘোড়াকে উসকানি দেয়.. "টাট্টু! আরো রোষে।" তির গাছে বিঁধলে শর্মী লাগাম টেনে ঘোড়াকে থামিয়ে ঝম্পে নেমে ঘোড়ার দিকে তাকিয়ে মুখ বিকৃত করে বলল... "ভুসি তুষ খেয়ে তুই খোদার খাশি হয়েছিস! রোষ-জোশের লেশ তোর মাঝে নেই। নিস্তেজ কোথাকার!" ঘোড়া হ্রেষাধ্বনি করে মাথা নাড়ে। অনতিদূরে শ্বেতকায় বাঘ খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে গোঙাতে দেখে শর্মী কোষ থেকে ভোজালি বার করে চারপাশে তাকিয়ে কিছু দেখতে না পেয়ে কান পাতে রাগান্বিতকণ্ঠে বলল… "কাঙালের দল! ধরতে পারলে আমি তোদেরকে আচ্ছা করে ঠ্যাঙাব মনে রাখিস!” বাঘ গর্জিয়ে গোঙালে কিছু লোক আছাড়ি পিছাড়ি খেয়ে দৌড়ে পালায়। শর্মী ভোজালি কোষে রেখে ঘোড়ার লাগাম ধরে ধীরে ধীরে এগিয়ে বলল... "আপোশে পোষ মানলে আশেপাশে থাকতে পারবে নইলে আজীবন আপসোস করবে। টাট্টু! আগ বাড়। বাগুরা ভেঙে বাঘকে মুক্ত করতে হবে। মুক্ত হয়ে অকৃতজ্ঞের মত আক্রমণ করলে কী করব?" ঘোড়া আগপিছ করে বার বার মাথা নাড়ে। শর্মী ঘোড়ার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল… “খামোখা দুশ্চিন্তা করিস না। কামড়াকামড়ি করার জন্য ল্যাংড়া এখন দাঁড়াতে পারবে না। বেঘোরে মরার জন্য বন্য বাঘের সাথে মারামারি করব না।” ঘোড়া ডানে বাঁয়ে তাকিয়ে কান নাড়ে। শর্মী অনুপল চিন্তা করে মেনি বিড়ালকে আদর করছে এমন শব্দ করে অগ্রসর হয়। বাঘ হুংকার করলে শর্মী কয়েক পা পিছিয়ে মুখ বিকৃত করে বলল... "হুলোর নাতি শার্দূল! তুই আস্ত একটা গর্দভ।" বাঘ আবার হুংকার করলে শর্মী অনুতপ্ত হয়ে ঘোড়ার গায়ে হেলান দিয়ে চোখ পাকিয়ে দাঁত খিচিয়ে বলল... "হেঁই! আমাকে ভড়কালে ওরা তোর চামড়া খুলে নেবে। সচেতনভাবে বুঝার চেষ্টা কর, বুঝেশুঝে কেউ কখনো বাঘের ভোজন হয় না। আমি তোকে সাহায্য করতে চাই, কামড়াকামড়ি করলে বেঘোরে মরবে। আমার পোষ্য হলে নিজের পছন্দমতো খাবার পাতে পাবে। মুখ বুজে চোপ-চাপ বসলে ছুমন্তর বলে আমি তোকে এখুনি মুক্ত করব।" ধমক কোঁদায় বাঘ শান্ত হয়। শর্মী ধীরে ধীরে হেঁটে গাছে হেলান দিয়ে বসে বাঘের সাথে কথা বলে.. "তোর নাম কী? জানি তুই কথা বলতে পারিস না। শোন! আমার সঙে চল, ভাঙা ঠ্যাঙে পট্টি বাঁধলে হাড় জোড়া লাগবে নইলে ল্যাংড়িয়ে ল্যাংড়িয়ে মরে যাবে।" শর্মীর কথায় কান না দিয়ে বাঘ অন্যদিকে তাকায়। শর্মী দাঁত কটমট করে তির দিয়ে খোঁচা দিতে চাইলে বাঘ গর্জে উঠে। শর্মী বুকে থু থু দিয়ে কপট হেসে পিছু হেঁটে মুখ বিকৃত করে বলল... "তুই এত শঙ্কিল কেন? তোর তর্জন গর্জনে আমার কলিজা কাঁপতে শুরু করেছে।" বাঘ গোঙালে শর্মী অধরদংশে থাপ্পড় দেখিয়ে চোখ পাকিয়ে বলল... "আবার গর্জিলে বাণ মেরে আমি তোর জান বার করব মনে রাখিস।" বাঘ শান্ত হয়ে ডানে বাঁয়ে তাকায়। শর্মী এগুতে শুরু করে শান্তকণ্ঠে বলল... "তুই কত ভদ্র, কত ভালো, কত সুন্দর। সত্যি বলছি, আমি তোকে পোষতে চাই। তোরে তোর চামড়ার দোহাই! ভাঙা ঠ্যাং দিয়ে আমার ঘাড়ে চাপড় মারিস না।"

You must be logged in to post a comment.